রুটির নাম বারবারি পাউরুটি হলো ‘বয়গেট’

ইরানের খাবার-দাবার ‘গাজা’ নিয়ে আগের সপ্তাহে যে ডায়েরি লিখেছিলাম তা পড়ে অনেক পাঠক ইরানে ব্যবহৃত রুটি সম্পর্কে জানতে চেয়েছেন। কেউ কেউ ইরানি দুই একটি খাবারের পূর্ণাঙ্গ রেসিপিও চেয়েছেন। তাতে বোঝা যায়-ইরানি খাবারের প্রতি বাংলাদেশী লোকজনেরও আলাদা একটা আকর্ষণ আছে। সুযোগ করতে পারলে না হয় একদিন ইরানি খাবারের রেসিপি নিয়ে কথা বলবো। যাহোক, আজ তেহরানের ডায়েরিতে কথা বলবো ইরানের রকমারি রুটি নিয়ে। বলে রাখি- এখানকার রুটি হোক আর ভাত হোক সবকিছুতেই একটা শিল্পের ছোঁয়া আছে। ফারসি ভাষায় রুটিকে ‘নুন’ বলা হয়।

ইরানি রুটি নিয়ে কথা বলতে গেলে আমার চোখে সবার আগে ভেসে ওঠে ‘নুনে বারবারি’। এই নুনেবারবারির দোকান রাজধানী তেহরানের প্রতিটি প্রায় মহল্লায় রয়েছে। এক একটা রুটিতে প্রায় ২৫০ গ্রাম আটা ব্যবহার করা হয়। আটা খামির করার পর গোল করে রাখা হয় টেবিলেরওপর। এক বারে অন্তত ৩০/৪০টি রুটি বানানোর আয়োজন করা হয়। আটার দলা চ্যাপ্টা করে তার ওপর দেয়া হয় এক ধরনের মাখন জাতীয় তেল। পরে হাত দিয়েই চ্যাপ্টা করে লম্বা অথবা গোলরুটি তৈরি করা হয়। এ কাজগুলো যিনি করেন তার কাছে বলা যায় নিমিষের ব্যাপার এবং বেশ শিল্পসম্মত। নুনেবারবারি তৈরি হয়ে গেলে তার ওপর সাদা তিল দেয়ার রেওয়াজ আছে। অবশ্য, কখনো কখনো তিল ছাড়াও বানানো হয় এ রুটি। তিল দেয়া রুটিকে বলে ‘কুনজেদার’। দামও সামান্য বেশি হয়। এ রুটি স্যাঁকার জন্য রয়েছে লোহার বিরাট বড় তাওয়া। নিচে গ্যাসের চূলা আর ওপরে ঘুরতে থাকে সে তাওয়া। ফলে যিনি বারবারি বানাচ্ছেন তিনি সহজেই রুটির বিষয়ে পরিপূর্ণ খোঁজ-খবর নিতে পারেন-স্যাঁকা হলো কিনা। নুনেবারবারি কিনতে হলে রুটির দোকানের সামনে লাইন ধরে দাঁড়াতে হবে। এ কথা কাউকে বলে দিতে হয় না। যিনি আসবেন তিনি নিয়ম মতো লাইন দাঁড়াবেন। একটা রুটির জন্য এক লাইন আর দুই বা তার বেশি রুটির জন্য ভিন্ন লাইন। এখানে কোনধ রনের বিশৃঙ্খলা নেই। গরম রুটি তাওয়া থেকে তুলে নির্ধারিত মূল্যে বিক্রি হবে। কোনো হই-হট্টগোল নেই।

মজার বিষয় হচ্ছে- গরম রুটি নিয়ে বাসায় যাওয়ার পথেই শুরু হয়ে যায় খাওয়া। গরম রুটির ঘ্রাণ আর স্বাদও আলাদা রকমের। বেশির ভাগ নারী-পুরুষ কিংবা ছেলেপুলেদের দেখা যাবে রুটির টুকরো ছিঁড়ে মুখে দিচ্ছে। প্রতিটি মহল্লায় এ ধরনের রুটির দোকান থাকার কারণে রাজধানী তেহ্‌রানে চাইলে খাবারের সময় প্রতিবারই গরম ও তাজা রুটি খাওয়া সম্ভব। নুনেবারবারি খাওয়া হয় সাধারণত পনির দিয়ে। ইরানে রুটি আর পনির হচ্ছে সকালের খুব প্রচলিত নাস্তা। বারবারি খাওয়ার আরও যেসব উপকরণ ব্যবহার করে ইরানিরা তার মধ্যে রয়েছে ডিম, স্যুপ, বাটার, টমেটো, শসা ইত্যাদি।

নুনে সাঙ্গাক’ হচ্ছে ইরানের আরেকটি বিখ্যাত রুটি। এটি বানানো হয় পাথর বসানো চুলায়। ফারসি ভাষায় ‘সাঙ্গ’ অর্থ পাথর। পাথরের চূলায় বানানো হয় বলে একে বলে নুনে সাঙ্গাক। এ রুটির সাইজও বেশ বড় আর লম্বা হয়। বারবারির চেয়ে তুলনামূলক সামান্য পাতলা হয় এ রুটি। পনির, বাটার, জ্যাম, গোশত,স্যুপ, ইত্যাদি দিয়ে খাওয়া যায় নুনে সাঙ্গাক। নুনে সাঙ্গাকের দোকানের সামনেও ভিড় জমে; তবে সুশৃঙ্খল লাইনে দাঁড়িয়ে রুটি সংগ্রহ করার নিয়ম রয়েছে। গরম গরম এ রুটি গরুর গোশ্‌ত কিংবা দুম্বার গোশ্‌ত দিয়ে খেতে অতুলনীয়।

নুনে লাবশ’ হচ্ছে সবচেয়ে বেশি প্রচলিত রুটি। এটি খুব পাতলা হয়। তৈরি হয় মেশিনে। ফলে একই রকম সাইজ ও আকৃতির হয়। মেশিনে রুটি তৈরির কারণে খুব দ্রুত কাজ এগিয়ে যায়। রুটির কারিগর হিসেবে কাজ করা দুই ব্যক্তিকে তাই ব্যস্ত থাকতে হয় অনেক বেশি। একজন রুটি তৈরি করছেন আরেকজন সেই রুটি তুলে তাওয়ায় দিচ্ছেন। নিচে গ্যাসের চূলার ওপর তাওয়াটি ঘুরতে থাকে আর কারিগরকে খুব দ্রুত সে রুটি তুলে নিতে হয়। পাতলা হওয়ায় বেশিক্ষণ রাখার সুযোগ নেই; পুড়ে যাবে। এ রুটি সকালের নাস্তায় যেমন ব্যবহৃত হয়, তেমনি দুপুরে ভাতের সঙ্গেও ইরানের লোকজন অনেকে খেয়ে থাকে। লাবশ যেখানে বানানো হয় তার আশপাশে আলাদা রকমের মিষ্টি ঘ্রাণ মৌ মৌ করে। নুনে লাবশ বাসায় এক-দু’দিন রেখেও খাওয়া যায়; নষ্ট হয় না। ইরানের আবহওয়া অতিমাত্রায় শুষ্ক হওয়ার কারণে কোনোকিছু সহজে নষ্ট হয় না বা পঁচে না।

নুনে তাফতুন’ হচ্ছে ইরানের প্রচলিত রুটির মধ্যে আরেকটি। এ রুটি আমাদের দেশের অনেকটা তন্দুর রুটির মতো। তবে স্বাদ একটু আলাদা। ইরানি নুনে সাঙ্গাকের চেয়ে একটু সামন্য পাতলা। গরম গরম খেতে আলাদা স্বাদ। সকালের নাস্তায় অথবা রাতের খাবারে এ রুটির ব্যবহার রয়েছে। আরও নানা ধরনের রুটি এখানে কিনতে পাওয়া যায়। এক ধরনের নান রুটির মতো পাওয়া যায় প্যাকেটজাত রুটি। তার স্বাদও বেশ চমৎকার।

এছাড়া, নানা ধরনের পাউরুটি তো আছেই। পাউরুটির মধ্যে এক ধরনের পাউরুটি আছে আকারে বেশ লম্বা; নাম তার ‘বয়গেট’। এ রুটি তেহরানে প্রধানত স্যান্ডউইচ করে খাওয়া হয়। নানা ধরনের কাবাব কিংবা মুরগির কলিজার সঙ্গে ভিনেগারে ভেজানো টক-শসা ও টমেটো দিয়ে তৈরি হয় স্যান্ডউইচ। টক-ঝাল সস দিয়ে গরম গরম খাওয়ার মজাই আলাদা। সকালে যে রুটি থাকে নিতান্তই নাস্তার সামগ্রী সেই রুটি রাতের বেলায় হয়ে ওঠে ইরানিদের ভারি খাবারে উপকরণ। রাতের বেলা ইরানের লোকজন সাধারণত রুটি খেয়ে থাকে। সে রুটির সঙ্গে থাকে পনির, জ্যাম-জুস, গোশত কিংবা নানা ধরনের বিখ্যাত ও মুখরোচক সব কাবাব

Comments